গর্ভাবস্থায় জরায়ুর ইনফেকশন একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যা গর্ভবতী নারীদের জন্য অনেক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
অনেক নারী গর্ভাবস্থায় যোনিপথে চুলকানি অনুভব করেন, যা একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা।
গর্ভকালীন নানান শারীরিক ও হরমোনগত পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হরমোনের মাত্রা পরিবর্তিত হওয়ার ফলে শরীরের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি যোনির স্বাস্থ্যেরও পরিবর্তন ঘটে, যা কখনো কখনো চুলকানি সৃষ্টি করে।
তবে, চুলকানি যে সবসময় স্বাভাবিক তা নয়; এটি কখনো কখনো যোনিপথে সংক্রমণের লক্ষণও হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় জরায়ুর ইনফেকশন লক্ষণঃ
গর্ভাবস্থায় জরায়ু বা ইউটেরাসের ইনফেকশন মারাত্মক হতে পারে, কারণ এটি মা এবং শিশুর জন্য বিভিন্ন জটিলতার কারণ হতে পারে, সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
- পেটের নিচের দিকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা – বিশেষ করে যদি এই ব্যথা বা চাপ স্থায়ীভাবে থাকে।
- অস্বাভাবিক বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব – স্বাভাবিকের তুলনায় ঘন, হলুদ বা সবুজাভ স্রাব দেখা যেতে পারে, যা ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে।
- জ্বর ও ঠান্ডা লাগা – শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং ঠান্ডা লাগা ইনফেকশনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
- প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া – প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া অনুভব হলে এটি ইউটেরাইন বা ইউরিনারি ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে।
- খাবারে অরুচি ও বমি বমি ভাব – অনেকসময় ইনফেকশনের কারণে খাবারে অরুচি বা বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
- বিপাকের গতি পরিবর্তন – ইনফেকশনের ফলে অতিরিক্ত গ্যাস বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
- শরীর দুর্বল বা ক্লান্ত লাগা – ইনফেকশন থাকলে শরীর সব সময় দুর্বল ও ক্লান্ত অনুভব করতে পারে।
কারণঃ
গর্ভাবস্থায় জরায়ুর সংক্রমণের কারণগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হলো:
- ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ: স্ট্রেপ্টোকক্কাস, স্ট্যাফাইলোকক্কাস, বা ই-কোলাই জাতীয় ব্যাকটেরিয়া জরায়ুতে পৌঁছে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া সাধারণত প্রস্রাব বা যোনির মাধ্যমে জরায়ুতে প্রবেশ করে।
- ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI): গর্ভাবস্থায় প্রস্রাবে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা থেকে জরায়ুতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
- সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন (STI): গনোরিয়া, ক্ল্যামাইডিয়া, ও হার্পিসের মতো সংক্রমণ যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
- মেডিকেল পদ্ধতির কারণে সংক্রমণ: গর্ভধারণকালীন কিছু মেডিকেল পরীক্ষা যেমন অ্যামিনোস্যন্টেসিস বা সিভি স্যাম্পলিং-এর সময় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ইনফেকশন ছড়াতে পারে।
- যোনির সংক্রমণ: যোনিতে ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস বা ইস্ট ইনফেকশন থাকলে তা জরায়ুতে পৌঁছে সংক্রমণ করতে পারে।
- অপর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যহীন জীবনযাপন: গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পরিচ্ছন্নতা, এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- ইমিউনিটি কমে যাওয়া: গর্ভাবস্থায় ইমিউন সিস্টেম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে শরীর সহজেই সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে।
এমন কোনো লক্ষণ বা ঝুঁকি দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
চিকিৎসাঃ
গর্ভাবস্থায় জরায়ুর সংক্রমণের চিকিৎসা দ্রুত ও সঠিকভাবে করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মা ও শিশুর উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
চিকিৎসা সাধারণত সংক্রমণের কারণ ও সংক্রমণের মাত্রার ওপর নির্ভর করে। এখানে কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতির উল্লেখ করা হলো:
- অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ: সংক্রমণের ধরন অনুযায়ী, চিকিৎসক নিরাপদ ও কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ নির্ধারণ করেন।
- প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্টস: কিছু ক্ষেত্রে, প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট জরায়ুর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে।
- শরীরের জলীয়তা বজায় রাখা: সংক্রমণ মোকাবিলায় শরীরের পর্যাপ্ত জলীয়তা (হাইড্রেশন) বজায় রাখা জরুরি। পানি বেশি করে পান করুন।
- বিশ্রাম: পর্যাপ্ত বিশ্রাম সংক্রমণের সাথে লড়াইয়ে সহায়তা করে এবং গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ: প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলে সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া গর্ভবতী নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- দ্রুত ডাক্তারি পরামর্শ: যদি অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা যায়, যেমন- জ্বর, ব্যথা, স্রাবে গন্ধ, প্রস্রাবে জ্বালা, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
খাওয়া যাবে এমন খাবারঃ
- ফল ও সবজি: প্রতিদিন প্রচুর ফল ও সবজি খাওয়া উচিত। এতে ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায় যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: ডিম, মুরগির মাংস, মাছ (নিরাপদ প্রকারের), ডাল, বাদাম এবং দুধজাত পণ্য খাওয়া ভালো। প্রোটিন গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- পুরো শস্য: ওটস, ব্রাউন রাইস, গমের রুটি ইত্যাদি শস্যযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। এতে ফাইবার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান থাকে।
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: দুধ, দই, পনির এবং ক্যালসিয়ামযুক্ত সবজি, যেমন পালং শাক খাওয়া উচিত। ক্যালসিয়াম শিশুর হাড় ও দাঁত গঠনে সাহায্য করে।
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার: আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন পালং শাক, ব্রকলি, ডিম, মাংস, এবং ডাল খাওয়া জরুরি, কারণ আয়রন শরীরে হিমোগ্লোবিন বাড়ায় এবং অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে।
- ফোলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার: গর্ভাবস্থায় ফোলিক অ্যাসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবুজ পাতাযুক্ত সবজি, ডাল, ব্রকলি, এবং বিশেষভাবে সাপ্লিমেন্ট আকারে ফোলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা জরুরি।
এড়িয়ে চলা উচিত এমন খাবারঃ
- কাঁচা বা অপরিপক্ক মাছ ও মাংস: কাঁচা বা আধা সিদ্ধ মাছ বা মাংসে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা ইনফেকশনের কারণ হতে পারে।
- ক্যাফেইন: প্রতিদিন খুব কম পরিমাণে (প্রায় ২০০ মিলিগ্রাম বা কম) ক্যাফেইন গ্রহণ নিরাপদ, তবে বেশিমাত্রায় চা, কফি বা সোডা পান এড়ানো উচিত।
- কাঁচা ডিম: কাঁচা বা আধা সিদ্ধ ডিম খাওয়া এড়ানো উচিত, কারণ এতে স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া থাকার ঝুঁকি থাকে।
- নরম পনির: কিছু নরম পনিরে লিস্টেরিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা গর্ভাবস্থায় বিপজ্জনক।
- আলু চিপস বা প্রসেসড ফাস্ট ফুড: অতিরিক্ত লবণ, চিনি, ট্রান্স ফ্যাট এবং প্রিজারভেটিভ সমৃদ্ধ খাবার এড়ানো ভালো।
- অতিরিক্ত মিষ্টি: কেক, পেস্ট্রি, মিষ্টি পানীয় ইত্যাদির অতিরিক্ত পরিমাণ এড়ানো উচিত, কারণ এতে অতিরিক্ত ক্যালোরি থাকে যা ওজন বৃদ্ধির পাশাপাশি ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- মদ্যপান ও ধূমপান: এগুলো সম্পূর্ণ এড়ানো উচিত। মদ্যপান ও ধূমপান শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
পানি পান: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি। এটি শরীরে জলীয়তা বজায় রাখে এবং টক্সিন দূর করতে সহায়তা করে।
এই তালিকা মেনে চললে গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।
অন্যান্য পোস্ট আরো পড়ুন